পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র ৩য় অধ্যায়: পৌরনীতির মৌলিক ধারণাগুলোর (Fundamental Concept) মধ্যে অন্যতম হলো মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য। সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য মূল্যবোধের চর্চা, আইনের বিধি-বিধান মেনে চলা এবং সাম্যভিত্তিক সমাজে স্বাধীনতা উপভোগের পরিবেশ সৃষ্টিতে সদা সজাগ থাকা নাগরিকের দায়িত্ব। এই অধ্যায়ে পৌরনীতির মৌলিক ধারণা যেমন- মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য ইত্যাদি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সেই সাথে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এসবের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
উত্তর: মূল্যবোধ বলতে মানুষের সেইসব ইতিবাচক চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্পকে বোঝায় যা মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে। মূল্যবোধ হলো সামাজিক রীতিনীতি ও বিধিবিধানের সমষ্টি যা সমাজ কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য উপাদান।
এটি হলো সমাজের মানুষের মৌলিক বিশ্বাস, যা মানুষের নীতি ও চিন্তাচেতনার মানদণ্ড এবং যা মানুষকে ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করতে সহায়তা করে। এটি কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। স্থান এবং সময়ভেদে মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয়।
উত্তর: আইনের অনুশাসন বলতে বোঝায়, সকল নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সমানাধিকার প্রাপ্তির অধিকার। সমাজে যখন মানুষে মানুষে সাম্য ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত হয় এবং নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমদৃষ্টি লাভ করে, তখন আইনের অনুশাসন নিশ্চিত হয়।
উত্তর: আইনের চোখে সবাই সমান অর্থাৎ সব মানুষই আইনের দৃষ্টিতে সমান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন, রাজা-প্রজা সকলেই আইনের আওতাভুক্ত থাকবে। সূর্যের আলো যেমন সকলের ঘরে সমভাবে পৌছায়, আইন তেমনই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকলকে সমভাবে স্পর্শ করে।
উত্তর: ধর্মের বিধিনিষেধ দ্বারা মানুষ সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয় বিধায় ধর্মকে বিবেচনায় রেখেই আইন প্রণয়ন করা হয়। এভাবে ধর্ম আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। ধর্মীয় অনুশাসন এবং ধর্মগ্রন্থ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের জীবনবোধের খুব গভীরে নিহিত থাকায় অনেক বিধিনিষেধ ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
এ সমস্ত ধর্মীয় বিধিবিধানসমূহ পরে রাষ্ট্রীয় সমর্থন লাভ করে আইনে পরিণত হয়। প্রাচীন রোমান আইন ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি আইন ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। মুসলিম আইন প্রধানত কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। পারিবারিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনগুলো ধর্মকেন্দ্রিক। তাই বলা যায়, ধর্ম আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে।
উত্তর: আইনের শাসন নাগরিকদের মধ্যকার বৈষম্য দূর এবং তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা করে। আইনের শাসনের অর্থ আইনের প্রাধান্য স্বীকার করা এবং আইন অনুযায়ী শাসন করা। আইন নাগরিক স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সকলের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের মাধ্যমে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নাগরিক স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে। সুতরাং আইনের শাসনের দ্বারা সাম্য, স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা পায়।
উত্তর: আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক গভীর। আইন স্বাধীনতার রক্ষক ও অভিভাবক। আইনের অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা থাকে না। কেননা স্বাধীনতা কোনো ‘লাইসেন্স’ নয়। আইন স্বাধীনতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। সভ্য জীবনের প্রয়োজনীয় শর্তাবলি আইনের দ্বারা সুরক্ষিত ও সম্প্রসারিত হয়। এছাড়াও আইন স্বাধীনতাকে যেমন অর্থবহ করে, তেমনি এটি স্বাধীনতাকে ভোগ করার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। মোটকথা, আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
উত্তর: সামাজিক মূল্যবোধ বলতে মূলত সমাজ স্বীকৃত কতকগুলো রীতিনীতি, আদর্শ ও আচর-আচরণের সমষ্টিকে বোঝায়। যেসব চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামাজিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তার সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে। যেমন- সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সততা, সচেতনতাবোধ, আইনের শাসন, উদারতা, শিষ্টাচার, সহানুভূতি, সৌজন্যবোধ ইত্যাদি।
উত্তর: স্বাধীনতার একটি রক্ষাকবচ হচ্ছে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে সাধারণ জনগণ সকলেই আইন মেলে চলবে এবং আইন প্রদত্ত সুবিধাদি সমানভাবে ভোগ করবে। এটিই আইনের শাসনের মূল কথা। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে সরকার বা অন্যকোনো কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এভাবে আইনের শাসন স্বাধীনতার রক্ষাকারি হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
উত্তর: আইনের চারটি উৎসের নাম হলো- ১. প্রথা, ২. ধর্ম, ৩. বিচারকের রায়, ৪. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা।
i. প্রথা (Custom): প্রথা হলো আইনের প্রাচীনতম উৎস। সমাজে বহুদিন যাবৎ প্রচলিত রীতিনীতি, আচার-আচরণ এবং লোকাচারকে প্রথা বলে।
ii. ধর্ম (Religion): ধর্ম আইনের অন্যতম উৎস। সমাজের বিধি নিষেধ ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।
iii. বিচারকের রায় (Judicial Decision): প্রাচীন সমাজে বিজ্ঞজনেরা দ্বন্দ্ব-বিবাদ মীমাংসায় প্রথা ও ধর্মীয় আইনের অসম্পূর্ণতা ও অস্পষ্টতার কারণে নিজেদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে দ্বন্দ্বের মীমাংসা করে।
iv. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা (Scientific Discussion): প্রখ্যাত আইনবিদদের মূল্যবান আলোচনা আইনের একটি অন্যতম উৎস।
উত্তর: বিধিবিধান বা নিয়মকানুনকে আইন বলে। আইন হলো ফার্সি শব্দ, যার অর্থ নিয়মকানুন বা বিধিবিধান। সাধারণত আইন বলতে কতকগুলো নিয়মকানুনকে বোঝায়, যেগুলো সকল ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের আওতাধীন।
উত্তর: মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ও কল্যাণ বজায় রাখার জন্য আইন মান্য করা উচিত। আইন মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার উপভোগ করতে সাহায্য করে, স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে এবং সুন্দর সুশৃঙ্খল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন গঠনে সাহায্য করে। আইনের উপস্থিতি ছাড়া মানুষের পক্ষে উৎকৃষ্ট জীবন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই আইন মান্য করা উচিত।
উত্তর: রাজনৈতিক সাম্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সাম্যকে অর্থবহ করতেই সর্বপ্রথম অর্থনৈতিক সাম্য প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সাম্য বলতে উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করাকে বোঝায়। অর্থনৈতিক সাম্যের ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মানুষ কাজ করার, ন্যায্য মজুরি পাবার সুবিধা লাভ করে। তাছাড়া অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাজনৈতিক সাম্যও মূল্যহীন। তাই বলা যায়, সকলের জন্যে অর্থনৈতিক সাম্য অতি জরুরি।
উত্তর: সাম্য না থাকলে ব্যক্তি তথা সমাজজীবন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। তাই সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা অর্থহীন। সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সাম্য নিশ্চিত করার জন্যে স্বাধীনতার প্রয়োজন। স্বাধীনতার শর্ত পূরণ না হলে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর স্বাধীনতাকে ভোগ করতে চাইলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তা না হলে দুর্বলের সাম্য সবলের সুবিধায় পরিণত হবে। সাম্য ও স্বাধীনতা একই সাথে বিরাজ না করলে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করার প্রশ্নই ওঠে না। সাম্য উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ দূর করে, আর স্বাধীনতা সমাজের সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করার অধিকার দান করে। তাই বলা যায়, সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা অর্থহীন।
উত্তর: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করতে হবে। আর স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করতে হলে যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা, শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন, নৈতিকমান উন্নয়ন এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা।
উত্তর: নৈতিকতা হলো সমাজের বিবেকের সাথে সংগতিপূর্ণ কতকগুলো ধ্যানধারণা ও আদর্শের সমষ্টি বা সমাজ স্বীকৃত আচরণবিধি। নৈতিকতা মূলত এক ধরনের মানসিক অবস্থা, যা কাউকে অপরের মঙ্গল কামনা এবং সমাজের প্রেক্ষিতে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকে। মানুষের মনে উদ্ভব ও বিকশিত হয় নৈতিকতা এবং এটিকে লালন করে সমাজ। সত্য কথা বলা, গুরুজনকে মান্য করা, অসহায়কে সাহায্য করা, চুরি, দুর্নীতি থেকে বিরত থাকা এগুলো মানুষের নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ।
উত্তর: অর্থনৈতিক সাম্য বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের সকল ব্যক্তি তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী অর্থনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সকল মানুষ যখন কাজ করার, ন্যায্য মজুরি পাবার সুবিধা লাভ করে তখন তাকে অর্থনৈতিক সাম্য বলে। অর্থনৈতিক সাম্যের মূল কথা হচ্ছে যোগ্যতানুযায়ী সম্পদ ও সুযোগ বণ্টন। এক কথায়, অর্থনৈতিক সাম্য হচ্ছে উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূর করে সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করা।
উত্তর: অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে বোঝায় যোগ্যতা ও সামর্থ অনুযায়ী জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা এবং দৈনন্দিন অভাব, অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি। লাঙ্কির মতে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হচ্ছে ‘প্রতিনিয়ত বেকারত্বের আশঙ্কা ও আগামীকালের অভাব থেকে মুক্ত এবং দৈনিক জীবিকার্জনের সুযোগ প্রদান।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মতে, ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অর্থ অভাব থেকে মুক্তি।’ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া অন্যান্য স্বাধীনতা অর্থহীন। যোগ্যতা ও সামর্থ অনুযায়ী কাজ পাওয়া, উপযুক্ত মজুরি লাভ, বেকার ও বৃদ্ধ বয়সে ভাতা পাবার অধিকার, রুগ্ণ-অক্ষম অবস্থায় রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিপালন অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।
উত্তর: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কর্তব্য পালনে বিচারকদের স্বাধীনতাকে বোঝায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে সরকারের অন্য বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচার কাজ সম্পাদনকে বোঝায়। এক্ষেত্রে বিচারকগণ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে মতামত প্রকাশ করে থাকেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য।
উত্তর: রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য অত্যাবশ্যক কতকগুলো বিধিবিধানের সমষ্টি যা রাষ্ট্রের সকলের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে আইন বলে। সমাজজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সুস্থ রাষ্ট্রীয় জীবনযাপনের জন্য মানুষের কিছু কিছু বিধি-নিষেধ ও নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এসব বিধি-নিষেধ বা নিয়মকানুনই হচ্ছে আইন।
উত্তর: স্বাধীনতার চারটি রক্ষাকবচ হলো-
১. আইন: আইন স্বাধীনতার শর্ত ও প্রধান রক্ষাকবচ। আইন স্বাধীনতা ভোগের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং স্বাধীনতাকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে তোলে।
২. সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশ নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধকালে সেগুলো সম্পর্কে দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে না এবং সেগুলো সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা লাভ করে।
৩. আইনের শাসন: যে সমাজে আইনের শাসন কার্যকর থাকে স্বাধীনতা সেখানে পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করে।
৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিচার বিভাগকে যদি নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে গড়ে তোলা যায় তাহলে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত করা সম্ভব।
উত্তর: কারো ক্ষতি না করে নিজের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী কোনো কাজ করাকে স্বাধীনতা বলে। পৌরনীতি ও সুশাসনে স্বাধীনতা বলতে অপরের কাজে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না করে নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করার অধিকারকে বোঝায়। অর্থাৎ স্বাধীনতা হলো এমন পরিবেশ, যেখানে ব্যক্তি কোনো প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়া তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারে।
উত্তর: নৈতিক মূল্যবোধ বলতে সেসব মনোভাব ও আচরণকে বোঝায় যা মানুষ সবসময় ভালো, কল্যাণকর ও অপরিহার্য বিবেচনা করে মানসিকভাবে তৃপ্তিবোধ করে। জীবন চলার পথে ব্যক্তিকে তার কর্মপন্থা স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে কী করা উচিত নয়, সে বিষয়ে প্রত্যেককে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ব্যক্তির এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর তার জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে। এ ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত বিচারের জন্যে যে মূল্যবোধ, তাকে নৈতিক মূল্যবোধ বলা হয়।
উত্তর: পরিবারের সদস্যরা পারস্পরিক সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। এভাবেই পরিবার থেকেই মানুষের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা শুরু হয়। পরিবারকে একটি দেশ বা সমাজের ক্ষুদ্রতম একক হিসেবে ধরা হয়। পরিবার থেকেই ব্যক্তির শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। নৈতিকতা, আচার-আচরণের শিক্ষা ব্যক্তি পরিবার থেকে লাভ করে থাকে। ফলে ব্যক্তির মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই পরিবার থেকেই ব্যক্তির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা শুরু হয়।
উত্তর: সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে যা ঐ সমাজকে সুশাসনের দিকে ধাবিত করবে। তাই সামাজিক ন্যায়বিচার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে অতি প্রয়োজনীয়। সামাজিক ন্যায়বিচার বলতে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাজ, আচরণ ও ন্যায়- অন্যায় বিচারের মানদণ্ড এক ও অভিন্ন হওয়াকে বোঝায়। একটি সুন্দর নাগরিক জীবন গঠনে সামাজিক ন্যায় বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম।
উত্তর: আইন তৈরির পূর্বে মানুষ প্রচলিত প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো এবং এখনও মানুষ প্রথা দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই প্রথাকে আইনের অন্যতম উৎস বিবেচনা করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে যেসব আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি ও অভ্যাস সমাজের অধিকাংশ জনগণ কর্তৃক সমর্থিত, স্বীকৃত ও পালিত হয়ে আসছে তাকে প্রথা বলে।
প্রাচীনকালে আইনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তখন প্রচলিত অভ্যাস ও রীতি- নীতির সাহায্যে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হতো। কালক্রমে অনেক প্রথা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে আইনের মর্যাদা অর্জন করে। যেমন- ইংল্যান্ডের সাধারণ আইন প্রথাভিত্তিক। এ কারণে প্রথা আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
উত্তর: কোনো প্রজ্ঞাবান বিচারকের রায় পরবর্তীতে যখন অন্যান্য বিচারকের দ্বারা সমর্থিত ও গৃহীত হয় তখন তা আইনের মর্যাদা লাভ করে। বিচারকগণ অনেক সময় বিচার করতে গিয়ে নতুন আইনের সৃষ্টি করেন। একজন বিচারক সাধারণভাবে তার দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে বিচার কাজ পরিচালনা করেন।
তবে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনো মোকদ্দমা প্রচলিত আইনের আওতায় না এলে সেক্ষেত্রে বিচারকরা নিজেদের বিচার-বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার আলোকে রায় দিয়ে নতুন আইন সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে তা অন্যান্যদের দ্বারা সমর্থিত ও গৃহীত হয়ে আইনের মর্যাদা লাভ করে।
উত্তর: সাধারণভাবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারকে বোঝায়। ভোটদানের অধিকার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার, নিরপেক্ষভাবে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের অধিকার, সরকারি চাকরির অধিকার প্রভৃতি রাজনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে হ্যারল্ড জে লাস্কি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে ভূমিকা পালন করার ক্ষমতাকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলে’।
উত্তর: আইনের অনুশাসনের কারণে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ জনগণের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না। তাই আইনের অনুশাসনকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলা হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে আইনের অনুশাসন। আইনের অনুশাসন বলতে বোঝায় আইনের সুস্পষ্ট প্রাধান্য এবং আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। আর আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান হলে ধনী-গরিব সবাই সমানভাবে স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে। তাই আইনের অনুশাসনকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলা হয়।
উত্তর: আন্তর্জাতিক আইন বলতে বোঝায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে ঐকমত্য ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রণীত আইন, যা প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সুসম্পর্ক নিশ্চিত করে। অন্যভাবে বলা যায়, যে সকল প্রথা ও শর্তাবলি রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনগতভাবে কার্যকর বলে বিবেচিত হয় তাই আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্ব অপরিসীম।
আশাকরি “মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য – পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র ৩য় অধ্যায়” নিয়ে লেখা আজকের আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। পৌরনীতি ও সুশাসন এর সকল অধ্যায় এর প্রশ্নোত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।
Leave a Reply